সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রবাস গন্তব্যগুলোর একটি। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যান—কেউ কাজের খোঁজে, কেউ হজ বা ওমরাহ পালনের জন্য, আবার কেউ ব্যবসা বা শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে। তাইসৌদি আরবের ভিসার ধরন ও আবেদন প্রক্রিয়া মেয়াদ, ও শর্তগুলো জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজ আমরা এই গাইডে বিস্তারিতভাবে জানব সৌদি আরবের ভিসা সম্পর্কিত সবকিছু—২০২৫ সালের হালনাগাদ তথ্যসহ।
প্রথম অধ্যায়: সৌদি আরবের ভিসার ধরন ও আবেদন প্রক্রিয়া
সৌদি সরকার তাদের নাগরিক নীতি ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের ভিসা প্রদান করে থাকে। নিচে সবচেয়ে প্রচলিত ভিসাগুলো তুলে ধরা হলো—
১. কর্মসংস্থান ভিসা (Employment Visa):
এই ভিসা সৌদি আরবের কোনো কোম্পানি বা স্পন্সরের মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীদের জন্য ইস্যু করা হয়।
- আবেদনকারীকে প্রথমে বৈধ নিয়োগপত্র (Offer Letter) এবং ভিসা অনুমোদন নম্বর পেতে হয়।
- কাজের ধরন অনুযায়ী পেশা নির্ধারণ হয়, যেমন—ড্রাইভার, ইঞ্জিনিয়ার, হেলপার, নার্স, বা টেকনিশিয়ান।
- ভিসা পাওয়ার পর আবেদনকারীকে মেডিকেল টেস্ট ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স জমা দিতে হয়।
২. ভিজিট ভিসা (Visit Visa):
এটি মূলত আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের সদস্যদের দেখা করার জন্য দেওয়া হয়।
- সৌদি আরবে বসবাসরত কোনো ব্যক্তি “ইনভাইটেশন লেটার” পাঠিয়ে আবেদনকারীর জন্য ভিজিট ভিসা অনুমোদন করাতে পারেন।
- মেয়াদ সাধারণত ৩ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত হয়, এবং এটি একাধিকবার নবায়নযোগ্য।
৩. হজ ও ওমরাহ ভিসা:
প্রতিবছর বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান হজ ও ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে যান।
- ওমরাহ ভিসা সারা বছর পাওয়া যায়, কিন্তু হজ ভিসা শুধুমাত্র হজ মৌসুমে ইস্যু হয়।
- আবেদনকারীর বৈধ পাসপোর্ট, ছবি, টিকাদান সনদ ও অনুমোদিত হজ এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করতে হয়।
৪. ব্যবসায়িক ভিসা (Business Visa):
এই ভিসা সাধারণত উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী বা বাণিজ্যিক বৈঠকের জন্য যাওয়া ব্যবসায়ীদের জন্য।
- সৌদি চেম্বার অব কমার্স অনুমোদিত আমন্ত্রণপত্র (Invitation Letter) প্রয়োজন হয়।
- মেয়াদ সাধারণত ৯০ দিন পর্যন্ত হয়, এবং একাধিকবার প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
৫. রেসিডেন্স ভিসা (Iqama or Residence Visa):
এই ভিসা তাদের জন্য যারা সৌদি আরবে দীর্ঘ সময় বসবাস ও কাজ করবেন।
- কর্মসংস্থান বা পারিবারিক স্পন্সরশিপের ভিত্তিতে ইস্যু হয়।
- ভিসা অনুমোদনের পর আবেদনকারী সৌদি পৌঁছে “ইকামা” নামে পরিচিত বসবাসের আইডি কার্ড পান।
সৌদি আরবে রেসিডেন্ট পারমিট করার নতুন পদ্ধতি
সৌদি আরবে ট্যাক্সি আইনে নতুন পরিবর্তন
দ্বিতীয় অধ্যায়: সৌদি আরবের ভিসার ধরন ও আবেদন প্রক্রিয়া
১. অনলাইন আবেদন (Visa Application Portal):
সৌদি সরকার তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট visa.mofa.gov.sa এর মাধ্যমে ভিসা আবেদন গ্রহণ করে।
প্রক্রিয়াটি হলো—
- ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন ফর্ম পূরণ করা।
- পাসপোর্ট কপি, ছবি, টিকাদান সনদ, আমন্ত্রণপত্র, এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আপলোড করা।
- ভিসা ফি অনলাইনে পরিশোধ করা।
- আবেদন শেষে রিসিপ্ট প্রিন্ট করে সংরক্ষণ করা।
২. সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে যাচাই:
অনলাইন আবেদন সম্পন্ন হলে আবেদনকারীর তথ্য সৌদি দূতাবাস বা কনস্যুলেটে পাঠানো হয়।
- দূতাবাসে আবেদনপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়।
- কখনও কখনও সাক্ষাৎকার বা বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন করা হয়।
৩. মেডিকেল টেস্ট:
সৌদি আরবের কর্ম ভিসার জন্য “GAMCA” অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক।
- টেস্টে রক্ত, এক্স-রে, এবং সংক্রামক রোগের পরীক্ষা করা হয়।
- রিপোর্ট নেগেটিভ হলে তবেই ভিসা অনুমোদিত হয়।
তৃতীয় অধ্যায়: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
ভিসার ধরনভেদে কিছু পার্থক্য থাকলেও সাধারণভাবে নিচের কাগজপত্রগুলো প্রয়োজন হয়—
- বৈধ পাসপোর্ট (কমপক্ষে ৬ মাস মেয়াদসহ)
- পাসপোর্ট সাইজ ছবি (সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে)
- আমন্ত্রণপত্র বা স্পন্সর লেটার
- মেডিকেল সার্টিফিকেট
- পুলিশ ক্লিয়ারেন্স
- ভিসা ফি পরিশোধের রিসিপ্ট
- চাকরির চুক্তিপত্র (কর্ম ভিসার ক্ষেত্রে)
চতুর্থ অধ্যায়: ভিসা ফি ও মেয়াদ
ভিসার ধরন অনুযায়ী ফি ভিন্ন হয়ে থাকে।
- কর্ম ভিসা: প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ সৌদি রিয়াল
- ভিজিট ভিসা: প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ সৌদি রিয়াল
- ব্যবসায়িক ভিসা: ৫০০ রিয়াল পর্যন্ত
- হজ ও ওমরাহ ভিসা: সাধারণত বিনামূল্যে, তবে সার্ভিস চার্জ প্রযোজ্য
ভিসার মেয়াদ:
- ভিজিট ভিসা: সর্বোচ্চ ১ বছর
- কর্ম ভিসা: ২ বছর (নবায়নযোগ্য)
- ব্যবসায়িক ভিসা: ৩ মাস থেকে ১ বছর
- রেসিডেন্স ভিসা: ১ বছর (প্রতি বছর নবায়নযোগ্য)
পঞ্চম অধ্যায়: ভিসা বাতিল বা নবায়ন প্রক্রিয়া
১. ভিসা নবায়ন (Visa Renewal):
রেসিডেন্স বা কর্ম ভিসা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নিয়োগকর্তা বা স্পন্সর Absher Portal থেকে নবায়ন করতে পারেন।
নবায়নের সময় সাধারণত—
- পাসপোর্ট কপি
- ইকামা নম্বর
- নবায়ন ফি
- মেডিকেল রিপোর্ট
প্রয়োজন হয়।
২. ভিসা বাতিল (Visa Cancellation):
যদি কেউ সৌদি ত্যাগ করতে চান বা চাকরি পরিবর্তন করেন, তবে তার ভিসা বাতিল করতে হয়।
- স্পন্সরের মাধ্যমে বাতিলের আবেদন জমা দিতে হয়।
- বাতিল হওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশ ছাড়তে হয়।
ষষ্ঠ অধ্যায়: সৌদি ভিসা সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
১. সর্বদা অফিসিয়াল চ্যানেল ব্যবহার করুন। ভিসা ব্রোকার বা অবৈধ দালালের মাধ্যমে ভিসা নিলে প্রতারণার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
২. মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট অবশ্যই অনুমোদিত সেন্টার থেকে সংগ্রহ করুন।
৩. ভিসা জারি হওয়ার পর সমস্ত তথ্য (নাম, পাসপোর্ট নম্বর, মেয়াদ) ভালোভাবে যাচাই করুন।
৪. হজ বা ওমরাহ ভিসায় গিয়ে কাজ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ—এতে গ্রেফতার ও দেশে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকি থাকে।
৫. ভিজিট ভিসা নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস বা চাকরি করা আইনত অপরাধ।
সপ্তম অধ্যায়: সৌদি আরবের ভিসার ধরন ও আবেদন প্রক্রিয়া (২০২৫)
সৌদি আরবের ভিসার ধরন ও আবেদন প্রক্রিয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে—
- অনলাইন ভিসা ট্র্যাকিং সিস্টেম আরও আধুনিক করা হয়েছে।
- একাধিকবার প্রবেশের (Multiple Entry) ভিজিট ভিসা এখন আরও সহজে পাওয়া যাচ্ছে।
- হজ ও ওমরাহ ভিসার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে, যাতে মুসলমানরা সহজে জিয়ারত করতে পারেন।
- নারীদের জন্য আলাদা ও স্বাধীনভাবে ওমরাহ ভিসা পাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
শেষ কথা
সৌদি আরবের ভিসার ধরন ও আবেদন প্রক্রিয়া এখন আগের চেয়ে অনেক উন্মুক্ত এবং প্রযুক্তিনির্ভর। কাজ, ব্যবসা, শিক্ষা বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে যারা সৌদি যেতে চান, তাদের জন্য সঠিক ভিসা নির্বাচন ও আবেদন প্রক্রিয়া জানা অত্যন্ত জরুরি। ভুল তথ্য বা অপ্রস্তুতি অনেক সময় ভিসা বাতিলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সবসময় সরকার অনুমোদিত ওয়েবসাইট ও এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করুন এবং ভ্রমণের আগে সব তথ্য যাচাই করুন।
এই গাইডটি অনুসরণ করলে আপনি সৌদি আরবের যেকোনো ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া সহজে বুঝতে এবং সম্পন্ন করতে পারবেন।
